শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
Logo
logo

গর্ভাবস্থায় ধূমপান শিশুর জীবন ও মায়ের স্বাস্থ্যের নীরব শত্রু


উত্তরভূমি বার্তাকক্ষ প্রকাশিত:  ০৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:৫৫ এএম

গর্ভাবস্থায় ধূমপান শিশুর জীবন ও মায়ের স্বাস্থ্যের নীরব শত্রু

আমরা সাধারণত ধূমপান বলতে ক্যান্সার ও ফুসফুসের রোগের কথা ভাবি। কিন্তু এর ক্ষতি এর চেয়েও বহুদূর বিস্তৃত। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা কমায়, প্রসব জটিল করে তোলে, এমনকি মৃতশিশু জন্ম, জন্মগত ত্রুটি ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।

ভ্যাপিংকেও তরুণদের মাঝে ‘কুল’ বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাপিং মোটেই নিরাপদ নয়- এরও অনেক দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি রয়েছে, যা ধূমপানের সমতুল্য। 

প্রজনন ক্ষমতায় সরাসরি প্রভাব

আ কা ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নওশীন ইউসুফ জানান, ‘তামাকের নিকোটিন ও পুড়ে বের হওয়া কার্বন মনোক্সাইড পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে যায়। একইসঙ্গে নবজাতকের জন্য মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে নবজাতকের হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। এমনকি পরোক্ষ ধূমপানও শিশুর জন্য সমান ক্ষতিকর। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মায়ের ধূমপানের কারণে মৃতশিশুর ঝুঁকি ২৩% এবং জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি ১৩% বেড়ে যায়।

সামাজিক কলঙ্কে নারীদের নীরবতা

স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আছে সামাজিক বাধাও। অনেক নারী চিকিৎসকের কাছে নিজের ধূমপানের অভ্যাস লুকিয়ে রাখেন, কারণ তারা বিচারাধীন হওয়ার ভয় পান।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহীন বলেন, ‘প্রায় প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ১৩ জন ধূমপান-আসক্ত। কিন্তু সমাজের চোখে ‘খারাপ নারী’ আখ্যা পাওয়ার ভয়ে তারা সত্যটি স্বীকার করতে চান না। অথচ ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান ক্ষতিকর।’

তিনি আরও জানান, যারা সাহস করে নিজেদের অভ্যাস খোলাখুলি বলেন, চিকিৎসকরা তাদের সহায়তা ও পরামর্শ দেন অভ্যাস ছাড়তে।

মায়েদের ও নবজাতকের জন্য বিপজ্জনক

ডা. নওশীন সতর্ক করে বলেন, গর্ভাবস্থায় ধূমপানের কারণে শিশুর জন্ম ঠোঁট বা তালুতে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে হতে পারে। এতে নবজাতক খাওয়াতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট পায়। এমনকি মানসিক বিকাশও ব্যাহত হয়।

নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড সরাসরি প্রসবস্থলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে শেষ মাসগুলোতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় প্রসবস্থল ডেলিভারির আগে আলাদা হয়ে যায়, যার ফলে মায়ের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

ভ্যাপিংয়ের ভয়াবহ প্রভাব

গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ভ্যাপিংও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতের আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় প্রায় ৯ লাখ ২৪ হাজার নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭,৫৫২ জন গর্ভাবস্থায় ভ্যাপিং করেছেন বলে জানান।

ফলাফলে দেখা যায়, ভ্যাপিংকারী মায়েদের দুধ খাওয়ানোর সমস্যা ছাড়াও তাদের নবজাতক অকাল জন্ম, কম ওজন নিয়ে জন্ম ও জন্মগত ত্রুটির শিকার হয়। ভ্যাপের তরল থেকে নির্গত টেরাটোজেনিক রাসায়নিক গর্ভের প্রাথমিক ধাপে ভ্রূণের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।

ডা. ফারহীন বলেন, ‘ভ্যাপের ফল বা মিষ্টি সুবাসগুলো গন্ধে নিরাপদ মনে হলেও এগুলোতে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সক্ষম কণিকা থাকে। এমনকি নিকোটিন-মুক্ত ভ্যাপও বিপজ্জনক। এগুলো ফুসফুসে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে ফুসফুস সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস কঠিন হয়ে ওঠে।’

আসক্তি প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি

গবেষণা বলছে, বাবা-মা ধূমপানে আসক্ত থাকলে তাদের সন্তানদেরও ভবিষ্যতে একই অভ্যাসে জড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ডা. ফারহীন মনে করেন, ‘আসক্তি থেকে বের হওয়া কঠিন, তবে সহায়তা ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে তা সম্ভব। চিকিৎসা সহায়তা ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশ তৈরি এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।’

ধূমপান বা ভ্যাপিং অনেকের কাছে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত মনে হলেও এর প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়। মায়ের ক্ষেত্রে এটি জটিল গর্ভধারণ ডেকে আনে, আর শিশুর ক্ষেত্রে জীবন শুরু হওয়ার আগেই সংগ্রামের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকদের মতে, ধূমপান ছাড়ার সিদ্ধান্ত কেবল একজনকে নয়- প্রজন্মের পর প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারে।