উত্তরভূমি বার্তাকক্ষ প্রকাশিত: ০৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৩:২৬ পিএম

আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি, তাদের কাছে ফনিক্স সাইকেল এক নস্টালজিয়ার নাম। তখন ভারতের হিরো সাইকেলও ছিল বাজারে। তার বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলেন হার্টথ্রব নায়ক সঞ্জয় দত্ত, টেলিভিশনে দেখানো হতো। তারও ক্রেজ ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু ফনিক্স সাইকেল? কোনো রকম বিজ্ঞাপন ছাড়াই তখন রাজা। তো, সেই ফনিক্স সাইকেল ছিল সে সময়ের কিশোর ও তরুণদের কাছে স্বপ্নের বিষয়—এখন যেমন তরুণদের আরাধ্য রেসিং বাইকের রেপ্লিকা।
ফনিক্স নামের সে বাইসাইকেল মানুষের কাছে পরিচিত ছিল চায়না ফনিক্স নামে। এক রড ও দুই রড, এ রকমভাবে ভাগ করা হতো সে সাইকেলকে। মানে কোনো সাইকেলের ওপরের সংযোগকারী রড থাকত একটি, কোনোটির দুটি। তখনো ২৬ বা ৩২ ইঞ্চির মাপের বিষয়টা আমাদের মাথায় ঢুকত না। আমাদের চাহিদা ছিল এক রডের সাইকেল। তাতে ‘হাফ প্যাডেল’-এ চালানোর সুবিধা ছিল।
আমরা যখন সাইকেলে হাফ প্যাডেলের দুনিয়ায় মশগুল, তখন দেখতাম বিয়ের কথা উঠলেই ছেলের বাড়ির লোকদের কাছে জানতে চাওয়া হতো, হিরো না ফনিক্স সাইকেল? কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ফনিক্স সাইকেল জয়ী হতো। তারপর বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে খয়েরি কাগজ আর পলিথিনে মুড়ে চায়না ফনিক্স আসত মেয়ের বাড়িতে। কালো রং, চকচকে রুপালি রঙের ক্যারিয়ার, কালো সিট। সামনে হ্যান্ডেলের নিচে সোনালি রঙের ছোট্ট ধাতব পাতে লাল রঙের লোগো ছিল। তাতে খোদাই করা ছিল এক অদ্ভুত জীব। অনেক পরে জেনেছি, সেটা ছিল ড্রাগন। সেই লোগো ছিল আমাদের কিশোর মনের ভীষণ আগ্রহের জায়গা। হাত বোলাতাম তাতে। মনে মনে ভাবতাম, দেখিস, একদিন আমারও একখানা ফনিক্স সাইকেল থাকবে, বাবা কিনে দেবে! কোনো দিন অবশ্য তার মালিক হওয়া হয়নি, বলাবাহুল্য।
খানিক বড় হলে, মানে যখন আমরা সিটে বসে সাইকেল চালানো শিখলাম, দুনিয়াটা গেল বদলে। বুঝতে পারলাম, আমাদের বাবারা ফনিক্স সাইকেল কিনে দিতে পারবেন না। আশা দূরে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে সাইকেলের প্রচলন কমতে থাকল। যারা একসময় ফনিক্স সাইকেল কিনত, তারা মোটরসাইকেল কিনতে শুরু করল। গতি বাড়ল, ভালোবাসা থেকে গেল মনে। জীবনও বদলে গেল।
অনেক পরে, যখন আমাদের অবসর বিনোদনে যোগ হলো উইকিপিডিয়া, রাজ্যের তথ্য আসল আমাদের হাতে, জানলাম, ফনিক্স সাইকেলের নাম আসলে ফিনিক্স সাইকেল। ফিনিক্স পাখির নাম জানলেও ফিনিক্স সাইকেলকে কেন ফনিক্স নামে ডাকা হতো, তা এখনো বোধগম্য নয়। অবশ্য যে দেশে আনানাস হয়ে যায় আনারস আর হসপিটাল হয়ে যায় হাসপাতাল, সে দেশে ফিনিক্স বাইসাইকেলের নাম ফনিক্স হয়ে যাওয়াটা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা নয়। যা হোক, এই ফিনিক্স বা ফনিক্স বাইসাইকেল ছিল মেড ইন চায়না। চীনের সাংহাই ফিনিক্স বাইসাইকেল কোম্পানি এটি তৈরি করত। এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, সাংহাই থার্ড বাইসাইকেল ফ্যাক্টরি হিসেবে। এর পরে প্রতিষ্ঠাটি আরও বড় হয়ে ওঠে। তার ইতিহাস উইকিপিডিয়ার এই যুগে দুর্লভ নয়। ফিনিক্স ব্র্যান্ডের এই বাইসাইকেল ৫০টিরও বেশি দেশে সাইকেল রপ্তানি হয় বলে জানা যায়। তবে ফিনিক্স ট্রেডমার্কটি নাকি চীন দেশের প্রথম দশটি সুপরিচিত ট্রেডমার্কের মধ্যে একটি। আর এটি নিবন্ধিত হয়েছে ১০৪টি দেশে!
শোনা যায়, ফিনিক্স বাইসাইকেল চীনা জাতির বিশেষ গর্বের জিনিস। এক সময় বিদেশি নেতারা চীন সফরে গেলে তাঁদের উপহার হিসেবে একটি করে ফিনিক্স বাইসাইকেল দেওয়া হতো।
এই সাংহাই ফিনিক্স বাইসাইকেল কোম্পানির ফিনিক্স সাইকেলের জন্যই কি না, তা জানা না গেলেও, চীন নামের দেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাইসাইকেল ব্যবহারকারী মানুষের দেশ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, চীনে একসময় বাইসাইকেল ছিল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। ১৯৮০-৯০-এর দশকে চীনের শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন বাইসাইকেল ব্যবহার করত। বেইজিংয়ের মতো শহরে সকালবেলা নামত সাইকেলের ঢল! সে জন্যই হয়তো চীন দেশেই শুরু হয়েছিল সাইকেল নিয়ে যাবতীয় ভবিষ্যৎমুখী কাজ।
সেই নব্বইয়ের দশকে বেইজিং শহরে সাইকেলের জ্যাম নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। আর একুশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝিতে সে দেশেই তৈরি হয় সাইকেল শেয়ারিং বিপ্লব। ২০১৬-২০১৭ সালে মোবাইক বা ওফো-এর মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় সেখানে, সাইকেল শেয়ারিংয়ের ব্যবসা করার জন্য। ২০১৭ সালের মধ্যে চীনে ১৬০টিরও বেশি শেয়ার্ড বাইসাইকেল কোম্পানি চালু হয়েছিল। সেসব প্রতিষ্ঠানের মোট বাইসাইকেলের সংখ্যা ছিল ২ কোটিরও বেশি! ইউরোপের দেশগুলোতে এখন এ ব্যবসা বেশ জমজমাট বলে জানা যায়।
বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা থেকেই চীনে শুরু হয়েছিল ইলেকট্রিক বাইকের ধারণা। খেয়াল করলে দেখবেন, সেগুলো সাইকেলের চেয়ে খানিক বেশি গতির। কিন্তু মোটরবাইকের মতো নয়। চায়না অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের একটি গবেষণা অনুসারে, ২০২৩ সালে চীনে ই-বাইকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ কোটি!
এবার বাইসাইকেল নিয়ে চীনদেশের কিছু চিত্তাকর্ষক তথ্য দেওয়া যাক।
চীনের জিয়াংসু প্রদেশের কুনশান শহরে আছে একটি বিশালাকার বাইসাইকেলের ভাস্কর্য। স্থানীয় মানুষ এ ভাস্কর্যে এসে সাইকেলশিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। কারণ, ষাটের দশক থেকে চীনের জাতীয় জীবনে বাইসাইকেল এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিল। সে সময় দেশটিতে তৈরি হয়েছে বাইসাইকেল সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতি শুধু চীনকেই নয়, প্রভাবিত করেছিল প্রায় পুরো বিশ্বকে।
বেইজিং থেকে গুয়াংঝো, চীনের বাইসাইকেল সংস্কৃতির রূপান্তরের গল্পটা বেশ চিত্তাকর্ষক। চীনের রাস্তায় বাইসাইকেলের যে অগণিত চাকা ঘুরছে, তা কেবল একটি বাহন নয়, বরং দেশটির সামাজিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের জীবন্ত দলিল। একসময়ের ‘সাইকেল রাজ্য’ থেকে আজকের ‘ই-বাইক সাম্রাজ্যে’ রূপান্তরের এই গল্পে মিশে আছে নস্টালজিয়া আর উদ্ভাবনের মেলবন্ধন।
১৯৯৫ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধু বেইজিং শহরে ছিল ৮৩ লাখেরও বেশি রেজিস্টার্ড বাইসাইকেল। সকাল-সন্ধ্যা রাস্তায় আক্ষরিক অর্থে নামত বাইসাইকেলের স্রোত! সেই সময় ফোরএভার ও ফ্লাইং পিজিয়ন নামের আরও দুটি ব্র্যান্ডের বাইসাইকেল ছিল সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। অনেক পরিবারে বিয়ের সময় সে দুই ব্র্যান্ডের বাইসাইকেল অপরিহার্য যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হতো। কী, আমাদের দেশের যৌতুকের কথা মনে পড়ে? একসময় বিয়েতে দেওয়া হতো বাইসাইকেল ও টেলিভিশন! একই গল্প ছিল চীনেও।
মজার বিষয় হলো, ১৯৯০-এর দশকে বেইজিং ও শেনইয়াং-এর মতো শহরগুলোতে শুধু গাড়ি জ্যামই নয়, নিত্যনৈমিত্তিকভাবে হতো সাইকেল জ্যাম। শহরগুলোতে নির্মিত হয়েছিল বিশাল সাইকেল লেন নেটওয়ার্ক, কিছু শহরে বাইসাইকেলের জন্য আলাদা ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছিল। সেগুলো অবশ্য কমতে শুরু করে ২০০০ সালের পর, নগরায়ণ ও মোটরগাড়ির বিস্তারের কারণে।
চীনের বাইসাইকেল সংস্কৃতির এই বিবর্তন শুধু পরিবহন পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, বরং এটি দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের জীবন্ত প্রতিফলন। এটি শুধু যে চীনকে প্রভাবিত করেছিল তা নয়। প্রভাবিত করেছিল বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরও বহু দেশকে, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে।